ওয়ারী বটেশ্বরঃ
ঢাকা শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে পুরাতন ব্রহ্মুত্র ও আড়িয়ালখাঁ নদীর মিলনস্থলের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে কয়সা নামক একটি প্রাচীন নদীখাতের দক্ষিনতীরে উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থান। রাসত্মার দু’পাশে ফসল আর ফসলবিহীন ক্ষেতের প্রাসত্মর টিলাময় লাল মাটির এক অঞ্চল।
ব্রিটিশ আমলে নরসিংদী ছিল নারায়নগঞ্জ মহকুমার অমত্মর্গত এলাকা। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭-এ নরসিংদী মাহকুমায় উন্নীত হয়। বর্তমানে ছয়টি থানা নিয়ে (নরসিংদী সদর, বেলাব, মনোহরদী পলাশ, রায়পুরা ও শিবপুর) নরসিংদী জেলা ঠিত হয়। নরসিদী জেলার বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়নের উয়ারী বটেশ্বর গ্রাম সেই প্রাচীন পত্নতাত্ত্বিক জায়গা।
হানিফ পাঠান উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসংগ্রহের সূচনা করে গেছেন। সেই পথ ধরেই বর্তমানে তাঁর বংশধর সকল প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ সংরক্ষন করেছেন। সে জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কথা বললেই ঠিকানা বলা হয় ‘‘ হানিফ পাঠানের বাড়ি’’। বেলাব সদর উপজেলা থেকে উয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নস্থলটি ৪ কিলোমিটার দূরে। প্রথমে হানিফ পাঠান এই গ্রামগুলোতে কিছু প্রাচীন ছাপাংকিত রৌপ্য মুদ্রা খুজে পান এবং সন্দেহ করেন তা মৌর্য সভ্যতার সময়কার খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী পর্যমত্ম। হানিফ পাঠান ও হাবিবুলস্না পাঠান এই কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি মিউজিয়াম গড়ে তুলেছেন। বশত বাড়ীর একটি ঘরের এক পাশে কাচ দিয়ে ঘেরা কতগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন রয়েছে যথাক্রমে: ছাপাংকিত রৌপ্য মুদ্রা, ১৯৯৭ সালে প্রাপ্ত ১৫-১৬ শতক আগের ব্রেঞ্জ মূর্তি, ১৯৯৭ সালের পুকুর খননকালে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব ১-২ শক আগের প্রাচীন মৃৎপাত্র, ১৯৮৮ সালের প্রাপ্ত ১৯ শতক আগের ব্রোঞ্জের ১০০০ শতকের লৌহ-কুঠার ও প্রসত্মরীভূত কাঠ ইত্যাদি, ১৭ শতকের মনসা মঙ্গল কাব্য, ১৯ শতকের হসত্ম লিখিত সবচেয়ে ক্ষুদ্র কোরআন শরীফ, মিশরের প্যাপিরাস (সংযুক্ত প্যাপিরাস শিল্পকর্মটি প্রাচীন মিশরীয়গন যে পদ্ধতিতে প্যাপিরাস তৈরি করতো সেই পদ্ধতিতে তৈরি)। ২/১ টি ছড়া বেশিরভাগ প্রত্নবসত্মই, এই উয়ারী-বটেশ্বর থেকে প্রাপ্ত। এছাড়া ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাকালী কিছু ডকুমেন্টস তাঁদের সংগ্রহে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে গ্রিক রোমান লেখকদের বিবরণে আলোক্সজান্ডারের সমসায়মিক উপমহাদেশের সর্বপূর্বে যে অঞ্চলের শক্তিশালী গঙ্গাবাড়িই রাজ্য ও তাঁর রাজধানী গাঙ্গে বন্দর হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। পাঠানের দাবী হলো উয়ারী-বটেশ্বর সেই অঞ্চল।
মূলত ২০০ সালের এপ্রিল মাসেই প্রথমবারের মতো খনন কাজ করা হয়। তখন থেকেই নগর বৈশিষ্ট্যের ধারণাটি নিশ্চিত হতে থাকে। নেদারল্যান্ডে কার্ব-১৪ টেষ্টে তারিখ নির্ধারণের মাধ্যমে উয়ারী-বটেশ্বর গ্রাম দুটি দেশের সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীনস্থান। এতে যে সকল নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে সেগুলো ২৪৫০ বছর আগের অর্থাৎ খিস্টের জন্মের ৪৫০ বছর আগের বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তখন ছিল মৌর্যবংশের রাজত্বকাল। এরপর ২০০২ সালের জুন মাসে দ্বিতীয়বারের মতো খনন কাজ করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ছাড়াই এ অঞ্চল থেকে ভূ-পৃষ্ট সংগ্রহ হিসেবে উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চল থেকে এক হাজার লৌহ নিদর্শন, কয়েক হাজার ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা এবং প্রচুর সংখ্য স্বল্পমূল্যবান প্রসত্মরের পূজি সংগৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যকোন অঞ্চল থেকে এত লৌহ নির্দশন, ছাপাংকিত রৌপ্য ও প্রসত্মরের মূর্তি সংগ্রহ করা যায়নি। এছাড়াও পাওয়া গেছে নব্যপ্রসত্মর যুগের বৈশিষ্টযুক্ত প্রসত্মর ও অশ্মীভূত কাঠের হাতিয়ার, নকশাঙ্কিত রক্ষাকবচ, হাই-টিন ব্রোঞ্জ নির্মিত নবযুক্ত পাত্র, কাচের পুতি, বস্ন্যাক সিস্নপড ওয়্যার এবং পোড়ামাটি ও পাথরের বিবিধ নিদর্শন। মধ্যযুগের প্রথম দিকে দীর্ঘ আকার বিশিষ্ট অসম রাজার গড় নামে একটি দূর্গ পাওয়া গেছে। এই ধরনের প্রত্নবসত্ম উয়ারী-বটেশ্বর সংলগ্ন রাইঙ্গারটেক, কান্দুয়া এবং সোনরম্নতলায় লক্ষনীয় মাত্রায় পাওয়া গেছে। আসলে বেলাব থানা জুড়েই এই প্রত্নবস্ত্তর ক্ষেত্রস্থল।
হাবিবুল্লা পাঠানের মতে এখানে নব্যপ্রস্তর যুগ ও মৌর্য যুগের নির্দশন পাওয়া গেলেও একটা দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের পর শুধু পাল সময়কার নিদর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু মাঝামাঝি সময়টাতে আসলে কি ঘটেছিল, সে ব্যাপারে এখনও কিছু জানতে পারা যায় নি। তরে তাঁর মতে এই এলাকার সাথে রোম কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারও তখন জলপথে যোগাযোগ ছিল। কারণ বর্তমানে গ্রামের পাশের যে শুকিয়ে যাওয়া কয়ড়া নদীটি আছে, এটা একসময় ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত ছিল। আর অতীতেই শুধু নয় এখনও নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বাণিজ্য এলাবা গড়ে উঠে। উয়ারী-বটেশ্বরের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই ঘটেছিল।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস