Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ভাষা ও সংস্কৃতি

 

নরসিংদী নব প্রতিষ্ঠিত হলেও ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। নরসিংদীর পূর্বনাম মহেশ্বরদী এবং তার ও অনেক পূর্বে সমতটের একটি অংশ। নরসিংদীর ওয়ারী বটেশ্বর প্রতœত্তত্ব আবিষ্কারের পর নরসিংদীর প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও ভাষা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। নরসিংদীর মৌল সম্পদ তার ভাষা । আমাদের ভাষার মধ্যে যে কথ্যরূপ তা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। নরসিংদী এক সময় ঢাকার জেলা এবং নারায়নগঞ্জ মহকুমার অন্তর্ভূক্ত ছিল। নরসিংদীর ছয়টি উপজেলার শব্দ ও উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য আছে ।


নরসিংদীর বেশির ভাগ মানুষই নরসিংদীকে নসোন্দি উচ্চারণ করে থাকে। ভাষা এক বিচিত্র বিষয়। এক এক পেশার এক এক ভাষার শব্দ বিদ্যমান। বাসের ড্রাইভার, কন্ড্রাকটর, হেলপারদের ভাষার সাথে অন্যদের পাথক্য রয়েছে। বাজারের ভাষার সাথে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ভাষা মিলবে না, আদালতের ভাষা, তাছাড়া ধর্মীয় ভাষা, অশিক্ষিত কামার কুমারদের ভাষাদের মধ্যেও পাথক্য আছে। ড. মনিরুজ্জামান তাঁর নরসিংদীর ভাষা ও লোকজীবন বইয়ে উল্লেখ করেছেন এক এক বিষয়ের শব্দগুলি হলো এক এক ডোমেনগত বিষয়িক শব্দ। বিভিন্ন ডোমেন এ বিভক্ত শব্দ হলো যেমন-শিক্ষা, খেলাধূলা, শিল্প সংস্কৃতি, আতœীয়তা ইত্যাদি বিষয়ের বা ধারা গত শব্দ তার বইয়ে আরও উল্লেখ করেছেন।


শ্রীযুক্ত গোপাল হালদার বলেন- ক্রোশে ক্রোশে ভাষা ভিন্ন হয় কিন্তু তা নিতান্তই ভঙ্গি। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গেলেই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, স্বরাগত, পার্থক্য, ধ্বনিতে শব্দে-বাক্যে বিশিষ্টার্থক প্রয়োগে এই সত্য প্রতিপদে উপলব্ধি করা যায়। এই পার্থক্যই প্রতিটি উপভাষা যার যার সীমান্ত রক্ষায় ব্যস্ত, যদিও তার সাধারণ শব্দরেখা মন্ডল ভিন্ন রেখেও এই পার্থক্যের সাধারণ গড় নির্ণয় সম্ভব। এক সময় শিবপুর, বেলাব দুটিই রায়পুরা থানায় থাকলেও রায়পুরার কিছু অংশে বাঞ্চারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রভাব রয়েছে। কিন্তু শিবপুর ও বেলাবতে কিশোরগঞ্জ, কাপাসিয়া ও গাজীপুর এর প্রভাব রয়েছে। নরসিংদী এক সময় নারায়ণগঞ্জর অধীনে ছিল বিধায় নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ ভাষাও প্রায় একই রকম।


বর্তমান পলাশ উপজেলাটি শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পার্শে¦ কালীগঞ্জ উপজেলার সাথে যুক্ত ছিল । পলাশে ‘গ’ এর আধিক্য আছে ‘মিয়াগ’। মনোহরদীর ভাষার মধ্যে আলাদা একটা টান রয়েছে। গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলার ভাষা ও সংস্কৃতি এলাকাটিকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছে। খাইচুন, গেছুইন ইত্যাদি টান আছে। তাছাড়া কোথাও কোথাও ‘দো’ শব্দ প্রচলিত আছে যেমন- গেছুইন দো। বাড়তি দো শব্দ ব্যবহার করা হয়।


নরসিংদী সদরে ‘ক’ এর উচ্চারণ ‘হ’, কাকা এর উচ্চারণ কাহা, ঢাকা এর উচ্চারণ ঢাহা, দেখা এর উচ্চারণ দেহা ইত্যাদি।
নরসিংদীতে ড় এর ধ্বনি ‘র’ রূপে উচ্চারিত হয়। ‘ঘ’ এর ধ্বনি ‘গ’ রূপে উচ্চারিত। ‘ছ’ এর ধ্বনি ‘চ’ রূপে উচ্চারিত।
বেলাব উপজেলায় ‘হ’ এর উচ্চারণ ‘অ’ এবং ‘স’ এর উচ্চারণ ‘হ’ করা হয়। যেমন-হাতি উচ্চারণ করে আতি এবং সুতা উচ্চারণ করে হোতা ইত্যাদি।
নরসিংদীতে মহাপ্রাণ ধ্বনি স্থলে অল্প প্রাণ ধ্বনি উচ্চারণ করে থাকে যেমন- ‘ঘুম’ উচ্চারণ করে থাকে ‘গুম’। নরসিংদীর রায়পুরার ভাষার মধ্যে অন্য উপজেলা হতে পাথক্য রয়েছে। যেমন রায়পুরার সাধারণ মানুষ অনেকে রায়পুরাকে লাইপুরা, রবিবারকে লববার, রেললাইনকে লেললাইন, রাতকে লাত, ভালোকে বালা, কালোকে কাইল্লা ইত্যাদি উচ্চারণ করে থাকে।
শিবপুরের ভাষার মধ্যে অন্য থানা হতে পার্থক্য আছে। শিবপুর শব্দটি শিববুর উচ্চারণ করে। যোশর শব্দটি যোয়র উচ্চারণ করে। কুন্দার পাড়া এর উচ্চারণ করে কুন্দরপারা; খৈনকুট এর উচ্চারণ করে খৈনপুট, পুটিয়ার বাজার উচ্চারণ করে পুইট্টার বাজার, লালখারটেক উচ্চারণ করে লালহারটেক, ইটাখোলা এর উচ্চারণ করে ইটখলা, টাকা উচ্চারণ করে টাহা/ টেহা, সিএনবি উচ্চারণ করে সিনবি।‘ বড়’ , ‘জেরে’ বাড়তি উচ্চারনণ ।
মাইগ্রেটেডদের ভাষা অর্থাৎ কুমিল্লা, নোয়াখালি, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুর, বরিশাল অঞ্চলের লোকজন কর্মসংস্থানের জন্য অর্থাৎ চাকরী অথবা কাজের সন্ধানে এসে এখানেই বসতি স্থাপন করে অথবা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে তাদের ভাষার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
নরসিংদীর ভাষা পরিস্থিতি ও ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ :
১.হ এর স্থলে অ হয় । যেমন হাতে উচ্চারিত হয় আতে।
২. ‘ক’ উচ্চারিত হয় ‘হ’ । যেমন-বুকে উচ্চারিত হয় বুহে।
৩. আদি এবং অন্তে ‘এ’ স্বরধ্বনি ‘এ্যা’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়।যেমন: আদিতে তেল > ত্যাল, মেঘ > ম্যাঘ, বেল > ব্যাল, বেচা > ব্যাচা
অন্তে: রেখে > রাখা, বলে > বল্যা, দেখা > দেখ্যা/দেহা
৪. ‘খ’ এর উচ্চারণ ‘হ’ হয়। দেখা > দেহা
৫. কখনও ‘ই’ ধ্বনি ‘এ’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। যেমনÑ লিচু > লেচু, ইদুর > এদুর ইত্যাদি। আবার ‘এ’ ধ্বনি ‘ই’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়। সেলাই > সিলাই, শেখা > শিখা , গেলা > গিলা।
৬. আদি ‘ও’ ধ্বনি ‘উ’ ধ্বনিতে পরিনত হয়।
যেমন: তোমার > তুমার, সোজা > সুজা, ছোঁড়া > ছুঁড়া
৭. ব্যঞ্জন ধ্বনি । যেমন: ‘ড়’ এর উচ্চারণ ‘র’ হয়Ñ
কুড়াতলি > কুরাতলি, গাড়ী > গারী, দাড়ি > দারি
৮. ‘র’ এর উচ্চারিত ‘ড’ হয়ে যায়Ñ যেমন: কাঁঠাল > কাডাল
৯. মাঝে মাঝে আদিতে ‘র’ হয়ে যায় ‘ল’ যেমন:
রোববার > লোববার, রেললাইন > লেললাইন
১০. ‘শ’ ধ্বনি ‘স’ ধ্বনি হয়Ñ
যেমন: শীত > সীত
১১. কখনও কখনও ‘শ’ হয়ে যায় ‘হ’ ধ্বনিÑ
শিয়াল > হিয়াল, শ্বশুর > হয়োর
কখনও ‘স’ উচ্চারণ ‘হ’ হয় Ñ
সোনা > হোনা
১২. রূপতত্ত্ব: যেমন: গুলাহ/গুলান > গুলো, হেরে > দের, গতর > শরীর
গা > শরীর, গতরকাটা > শরীরিক শ্রম, গাও খাটা > শরীরিক শ্রম
১৩. সম্বোধন:
আমার > আমাগো / তোমাগো, চাচ্ছাগো, দাদীগো, মামুগো
নঞর্থক বাক্য ‘না’ বা ‘নাই’ শিষ্ঠ বাংলার মতই ক্রিয়াপদের পরে বলে। তবে সম্ভাবক বিধিভাবে ‘না’ ক্রিয়াপদের পূর্বে বসে। যেমন: না আইস্যা তুই বালাই করছিস।
নরসিংদীতে শব্দভেদের প্রয়োগ বহালÑযেমন:
ডাহা ডাহি, কানাকানি, মিছামিছি, টাহাটুহা, বকবক, লডরপডর
শব্দকোষ :
আদর্শ শিষ্ট বাংলা ভাষার মতই নরসিংদীর উপভাষাতেও তৎসম, অর্ধতৎসম, তদ্ভব, দেশি, বিদেশি শব্দ রয়েছে। তবে এই উপভাষার হিন্দি, পারসি, ভাষার রূপমূল বহুল ব্যবহৃত। সে তুলনায় তৎসম শব্দের ব্যবহার কম। এছাড়াও এ উপাভাষার নিজস্ব রূপমূল রয়েছে। নিচে বিভিন্ন প্রকার শব্দ কোষের তালিকা দেয়া হলো:
ক. তৎসম শব্দ: বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত এ জেলার উপভাষাতেও তৎসম শব্দের ব্যবহার খুব কম। তৎসম শব্দগুলো ঈষৎ পরিবর্তিত হয়। তবে কিছু কিছু শব্দে এই উপভাষাতেও শুদ্ধভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: বন্ধু, বল, বন, ছাত্র, পাত, শক্তি, যুদ্ধ, সুখ, স্বাস্থ্য, ভাগ্য, আকাশ, কৃষ্ণ ইত্যাদি।
খ. অর্ধতৎসম শব্দ:
তৎসম শব্দÑ উপভাষায় ব্যবহৃত:
ক্ষুধা > ক্ষিধা, শরীর > শরীল
গ. তদ্ভব শব্দ: যেমন: শিষ্ট বাংলা Ñ উপভাষা
গায় > গায়ে
ইঁদারা > ইদারা
পনর > পুন্ড
আরবি Ñ ফারসি Ñ তুর্কি থেকে গৃহীত শব্দ:
পর্তুগিজ থেকে গৃহীত শব্দ
শিষ্ট বাংলা Ñ উপভাষা
নোনা Ñ লোনা
বোতল Ñ বোতল
পেঁপে Ñ পাবদা
বালতি Ñ বালতি
পিরিচ Ñ প্রিচ
জানালা Ñ জিনালা
বয়াম Ñ বৈয়ম
সাবান Ñ হাবান
ইংরেজি থেকে গৃহীত শব্দ:
শিষ্ট বাংলা Ñ নরসিংদীর উপভাষা
গ্লাস Ñ গেলাস
প্যান্টস Ñ প্যান
পেন্সিল Ñ পিনসিল
টেবল/টেবিল Ñ টেবিল
বক্স Ñ বাক্সো
ট্রেন Ñ টেরেন
রিফিউজি Ñ রিফুজি
টিকেট Ñ টিহেট
কন্ট্রোল Ñ কনটোল
সিগনাল Ñ সিঙ্গেল
ম্যাজিস্ট্রেট Ñ ম্যাসটেট ।

এফি= এদিকে
হেফি= সেদিকে
খায়াম=খাবো
যায়াম= যাবো
কুফি= কোনদিকে
টুক্কা= ছোট
টেল্যা= ঠান্ডা
ততা= গরম
ওসোরা= বারান্দা
ওগাইর= মাচা
যেরে= পরে
কুফিল= কোনদিকে
আইরো= আসো
আয়ুন যে= আসেন যে
হুরু= ধূর!
আছত= আছিস
যাইগগা= চলে যা
হুন= শুন
বাইত= বাড়ী
গুমিলা= গরম লাগা
জার করে = শীত করে
জব দে= জবাব দে।
ক্যাডা= কে
ডেগ= পাতিল
বাসন= প্লেট
পুষ্কুনি= পুকুর
পাইল্লা= পাতিল
দুয়ার= দরজা
তলে= নিচে
উরফে= উপরে
মারাম ধইরা= মারবো ধরে
বাইত= বাড়ী
হাইঞ্জা= সন্ধ্যা
ভেইন্নালা= সকাল বেলা
ভেন রাইত=ভোর রাত
কাইত্তান= কয়েকদিন যাবত বৃষ্টি
কইতাম= বলব
উইট্টা আয়= উঠে আয়
উচা= উচু
নেচা= নিচু
রাইত= রাত্র
ব= বস
কাইজ্জা= ঝগড়া
টাটকি= টয়লেট
খারা= দাঁড়ানো
খাওন= খাবার
আমনেরা= আপনারা
বেক্তে= সবাই
ইত্তা= এইসব
কইন= বলেন
হুনলে= শোনলে
কইব= বলব
কেওর= দরজা